
নেইমার-ভিনিসিউস-রিশার্লিসন ত্রয়ীর ব্রাজিলের দুর্দান্ত আক্রমণভাগ, কিলিয়ান এমবাপের গতি কিংবা জাদুকরী লিওনেল মেসি। কি মনে হচ্ছে, ফরোয়ার্ডরা নির্ধারণ করে দেবেন বিশ্বকাপ শিরোপা? তা হয়তো দিতেও পারেন। তবে নজর দিতে হবে মাঠের অন্য প্রান্তেও, রক্ষণভাগে।
অতীত ইতিহাস বলছে, বিশ্বকাপ জয়ের চাবিকাঠি হতে পারে এই রক্ষণ।২০১০ বিশ্বকাপের কথাই ধরা যাক। স্পেন তাদের চারটি নকআউট ম্যাচের প্রতিটিতে ১-০ গোলে জিতে শিরোপা উল্লাসে মেতেছিল। আরও বিশদভাবে দেখলে, সবশেষ ছয়টি বিশ্বকাপ জয়ী দলের ২৪টি নকআউট ম্যাচের ১৭টিতে ক্লিন শিট বা জাল অক্ষত ছিল।কাতার আসরে কোয়ার্টার-ফাইনালের লড়াই শুরু হচ্ছে শুক্রবার।
তার আগে দেখে নেওয়া যাক এই ধাপে আসা আট দলের এখনও পর্যন্ত কার রক্ষণের কী অবস্থা।টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে কাতারে এসে আর্জেন্টিনার শুরুটা মোটেও ভালো ছিল না। সৌদি আরবের বিপক্ষে শুরুতে এগিয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয়ার্ধে পাঁচ মিনিটের মধ্যে হজম করে দুই গোল। যার প্রথমটিতে রক্ষণের দুর্বলতা ফুটে ওঠে স্পষ্টভাবে।এরপর তারা ঘুরে দাঁড়ায় দারুণভাবে। রক্ষণভাগ দেখায় দৃঢ়তা। গ্রুপের বাকি দুই ম্যাচ জিতে নেয় তারা জাল অক্ষত রেখে।
শেষ ষোলোয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটি গোল যদিও তারা হজম করে, তবে অস্ট্রেলিয়ার ক্রেইগ গুডউইনের সেই শটে বল আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডার এনসো ফের্নান্দেসের মুখে লেগে দিক পাল্টে জালে জড়ায়।এরপর অ্যাজডিন রুস্টিককে দারুণ এক ট্যাকলে আটকে দেন ডিফেন্ডার লিসান্দ্রো মার্তিনেস। শেষ সময়ে দারুণ এক সেভ করেন এমিলিয়ানো মার্তিনেস। ম্যাচের পর রক্ষণের প্রশংসা করেন অধিনায়ক মেসি।গ্রুপ পর্বে প্রথম দুই ম্যাচে ব্রাজিলের রক্ষণকে সেভাবে পরীক্ষাই দিতে হয়নি। সার্বিয়া কিংবা সুইজারল্যান্ড, কেউ লক্ষ্যে কোনো শট নিতে পারেনি।
গ্রুপের শেষ ম্যাচে তারা ক্যামেরুনের বিপক্ষে শেষ দিকে একটি গোল হজম করে বটে, তবে নকআউটের টিকেট আগেই নিশ্চিত হওয়ায় ওই ম্যাচে প্রথম পছন্দের চার ডিফেন্ডারকে বিশ্রাম দিয়েছিলেন কোচ তিতে।শেষ ষোলোয় দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে প্রথমার্ধেই ব্রাজিল এগিয়ে যায় ৪-০ গোলে। বিরতির পর একটি গোল তারা হজম করে। তবে প্রায় ২৫ গজ দূর থেকে পাইক সিউং-হোর জোরাল শটে খুব বেশি কিছু করার ছিল না ব্রাজিলের রক্ষণভাগ কিংবা গোলরক্ষকের।
সেদিন দারুণ কয়েকটি সেভ করেন আলিসন।গ্রুপ পর্বে মরক্কো ও বেলজিয়ামের সঙ্গে গোলশূন্য ড্রয়ের মাঝে ক্রোয়েশিয়া একটি গোল হজম করে কানাডার বিপক্ষে ম্যাচে। শেষ ষোলোয় একটি গোল তারা খায় জাপানের বিপক্ষে, যে জাপান গ্রুপে সাবেক দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি ও স্পেনের বিপক্ষে জিতেছিল দুটি করে গোল করে।ওই দুই ম্যাচে প্রথমে গোল হজমের পর ঘুরে দাঁড়ায় ক্রোয়েশিয়া। কানাডার জালে বল পাঠায় চারবার, জাপানের বিপক্ষে সমতা টানার পর টাইব্রেকারে জেতে গত আসরের রানার্সআপরা।
আসরে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দারুণ ট্যাকল করে দলকে রক্ষা করেছেন লাইপজিগের ডিফেন্ডার ইয়োস্কো গাভারদিওল। ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো দালিচের চোখে, এই মুহূর্তে ‘বিশ্বের সেরা সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার’ ২০ বছর বয়সী এই ফুটবলার।বিশ্বকাপ অভিযান শুরুর আগে ইংল্যান্ড তাদের সবশেষ ছয় ম্যাচের মধ্যে ক্লিন শিট রাখতে পারে মাত্র একটিতে। হ্যারি ম্যাগুইয়ার ছন্দে না থাকার পরও টানা তাকে শুরুর একাদশে রাখায় প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন কোচ গ্যারেথ সাউথগেট।কোচের আস্থার প্রতিদান বিশ্ব মঞ্চে এখন পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই দিয়েছেন ম্যাগুইয়ার।
আসরে চার ম্যাচে ইংল্যান্ড গোল হজম করেছে দুটি, আর দুটিই গ্রুপ পর্বে ইরানের বিপক্ষে। প্রথম গোল হজমের আগে তারা এগিয়ে ছিল ৪-০, পরেরটির আগে ৬-১ গোলে। তাই দুর্ভাবনার তেমন কিছু ছিল না।কোয়ার্টার-ফাইনালের আট দলের মধ্যে একমাত্র ফ্রান্সই তাদের চার ম্যাচের প্রতিটিতে গোল হজম করেছে। কোচ দিদিয়ে দেশমের জন্য যা কিছুটা হলেও দুর্ভাবনার। যদিও শেষ ষোলোয় পোল্যান্ডের বিপক্ষে তিন গোল করার পর একেবারে শেষ মুহূর্তে পেনাল্টি থেকে একটি খায় তারা।চার বছর আগে রাশিয়া আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে কোয়ার্টার-ফাইনাল ও সেমি-ফাইনালে জাল অক্ষত রেখেছিল ফরাসিরা।
টুর্নামেন্টে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে কম গোল হজম করেছে মরক্কো। আফ্রিকার দেশটি জাল অক্ষত রাখে রাখে ইউরোপের ত্রয়ী বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া ও স্পেনের বিপক্ষে। একমাত্র কানাডার বিপক্ষে জাল অক্ষত রাখতে পারেনি তারা, সেটিও ছিল আত্মঘাতী গোল ।এমনকি, শেষ ষোলোয় স্পেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারেও জাল অক্ষত রাখে মরক্কো। প্রতিপক্ষের তিন শটের দুটি ঠেকিয়ে দেন গোলরক্ষক ইয়াসিন বোনো, একটি বাধা পায় পোস্টে।
প্রথমবারের মতো তারা উঠেছে কোয়ার্টার-ফাইনালে।তাদের এমন সাফল্যের পেছনের কারিগর কোচ ওয়ালিদ রেগরাগি। বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র তিন মাস আগে দায়িত্ব পান তিনি। তার কোচিংয়ে এখন পর্যন্ত আট ম্যাচ খেলে কেবল ওই আত্মঘাতী গোলটি হজম করেছে মরক্কো।এখনও পর্যন্ত আসরে যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি (১২) গোল করা পর্তুগালকে তাই শেষ আটে কঠিন পরীক্ষাই দিতে হবে মরক্কোর দেয়াল ভাঙতে।নেদারল্যান্ডস কোচ লুই ফন খাল আবারও তিন সেন্টার-ব্যাক কৌশলে আস্থা রেখেছেন।
তার কোচিংয়ে ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে ডাচদের সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত যেতে যা বেশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল।এবার গ্রুপ পর্বে তারা একটি গোল হজম করে একুয়েডরের বিপক্ষে, শেষ ষোলোয় যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে আরেকটি।আট বছর আগের বিশ্বকাপের চেয়েও এবার নেদারল্যান্ডসের রক্ষণ বেশ দৃঢ়। অধিনায়ক ভার্জিল ফন ডাইক, যাকে মনে করা হয় সময়ের সেরা ডিফেন্ডারদের একজন। ম্যানচেস্টার সিটির ডিফেন্ডার নাথান আকে ও আয়াক্সের ইউরিয়েন টিম্বারও ছন্দে আছেন। মাটাইস ডি লিখটের মতো দামি ডিফেন্ডার আছেন বেঞ্চে।
এই বিশ্বকাপ দিয়েই আন্তর্জাতিক ফুটবলে পথচলা শুরু করা গোলরক্ষক আন্ড্রিস নোপার্টও রাখছেন কোচের আস্থার প্রতিদান।আসরে এখনও পর্যন্ত যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি গোল যেমন করেছে পর্তুগাল, তেমনি কোয়ার্টার-ফাইনালের দলগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোল হজমও করেছে তারাই। তাদের শেষ আটের প্রতিপক্ষ যখন মরক্কো, তাই বলা যায় সবচেয়ে ‘সেরা’ আর ‘বাজে’ রক্ষণের দুই দলের লড়াই হতে যাচ্ছে এবার।
পর্তুগিজদের রক্ষণভাগের নেতৃত্বে আছেন ‘চিরতরুণ’ ৩৯ বছর বয়সী পেপে। সেন্টার-ব্যাক রুবেন দিয়াস বর্তমান সময়ে সেরাদের একজন।এই বিশ্বকাপের মতো ২০১৬ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও গ্রুপ পর্বে চার গোল হজম করেছিল পর্তুগাল। এরপর নকআউটে ক্রোয়েশিয়া, পোল্যান্ড, ওয়েলস এবং ফাইনালে ফ্রান্সকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল তারাই। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে? কে জানে!
কোয়ার্টার-ফাইনালের লাইনআপ:
ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া
আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস
ফ্রান্স-ইংল্যান্ড
মরক্কো-পর্তুগাল